অভিনয়ে শেখ হাসিনাকে টেক্কা দিতে পারে এমন একজন চলে এসেছে। ঠিক ধরেছেন, তিলোত্তমা শিকদারের কথাই বলছি।

বিকাল পৌনে চারটা। বাসায় চলছে হরেক রকমের ইফতার আয়োজন। যে আয়োজনে পরিবারের সবাই অংশ নিচ্ছেন। কাজেই রীতিমতো সবাই ব্যস্ত। এই সময়টাতে তেমন কথা বলার সুযোগ নেই। সন্দেহ নেই, গল্পটা মুসলিম পরিবারের হবে। কিন্তু না, এটি সনাতন ধর্মাবলম্বী এক তরুণীর পরিবারের আয়োজন। আর তা মুসলমান রোজাদারদের উদ্দেশ্যে। ইফতারের ঘণ্টা দুয়েক আগে বরিশালের সড়কে বেরিয়ে পড়েন তিলোত্তমা সিকদার। সঙ্গে একটি ভ্যান। যেখানে থাকে প্যাকেটবন্দি ইফতার সামগ্রী। ভ্যানটা পরিবহনের জন্য সিকদারের দুই তিনজন ছেলে বন্ধু সহযোগিতা করেন। রোজ ইফতারের আগের সময়টা শহরের বিভিন্ন অলিগলি ঘুরে অসহায় মানুষের মুখে ইফতার তুলে দেন তিনি। এবারের রমজানের শুরু থেকেই ইফতারের আগে বৃষ্টির বাগড়া। তবুও থেমে থাকেননি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়া তিলোত্তমা। বৃষ্টিতে ভিজেও করোনায় কর্মহীন দুস্থদের দুয়ারে ইফতার পৌঁছে দিচ্ছেন।
ইফতার পরিবেশনটাও নিজেই করেন ঢাবির এই সিনেট সদস্য। পরিবারের সহায়তায় নিজে হাতে তৈরি ইফতার সামগ্রী বিনামূল্যে বিতরণ করেন ভাসমান ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে। বাসা থেকে কয়েক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ইফতার বিলি করেন। একেক দিন যান একেক এলাকায়।
ছাত্রলীগ নেত্রী তিলোত্তমা সিকদার ডাকসুরও সদস্য। বিভিন্ন সময় আলোচনায় থাকা এই সিকদার অনেকেরই পরিচিত মুখ। তবে এখন তিনি করোনার স্বেচ্ছাসেবী বলে জানান।
করোনাভাইরাসে দেশের অসংখ্য মানুষের সানন্দের জীবনযাত্রা এখন বিষাদে পরিণত হয়েছে। গোটা দেশে টানা লকডাউনের মধ্যেই শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। টেনেটুনে সাহরি আর ইফতারের মধ্য দিয়ে রোজা রাখছেন হাজারো খেটে-খাওয়া মানুষ। বাধ্যতামূলক ঘরে বন্দি থাকায় বেশ বিপাকে পড়েছেন তারা। তাদের কষ্ট আর অস্বস্তি কিছুটা লাঘব করতেই সনাতন ধর্মাবলম্বী হয়েও তিলোত্তমার এই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। প্রথম রমজান থেকে শুরু করা এ উদ্যোগ শেষ রমজান পর্যন্ত চালাতে চান তিনি।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তিলোত্তমা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীদের উপসাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক। থাকেন কবি সুফিয়া কামাল হলে। করোনাভাইরাস ঠেকাতে লকডাউন ঘোষণার ৩-৪ দিন আগে চলে যান নিজ শহর বরিশালে। সেখান থেকে তিনি টেলিফোনে বলেন, করোনার কারণে লকডাউন দীর্ঘ হচ্ছে। চাইলেও এখন ঢাকায় আসতে পারছি না। রমজান মাসে লকডাউনে এলাকার নিম্নআয়ের অনেক মানুষ সাহরি না খেয়েই রোজা রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। অনিশ্চিত তাদের ইফতারের আয়োজন। তাদের কথা চিন্তা করে আমার সাধ্যমতো পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।
শুধু তাই নয়; লকডাউনের কারণে বিপদে পড়া ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিলোত্তমা সিকদার। ঢাবির ছাত্রদের মধ্যে যারা লকডাউনের কারণে টিউশনি বা বিকল্প আয়ের পথ হারিয়ে বিপদে পড়েছেন তাদের নাম সংগ্রহ করে সহযোগিতা করছেন তিনি।
দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তিলোত্তমা শিকদার জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ঢাবি শিক্ষার্থীদের বিকাশে টাকা পাঠাচ্ছেন তিনি। নিজ হল এবং আশপাশে যারা বিভিন্ন বাসায় আটকা পড়েছেন; তাদের জন্য ১০ কেজি চাল, দুই কেজি ডাল, দুই লিটার তেল ও আটা উপহার হিসেবে পাঠাচ্ছেন তিলোত্তমা। ফোনে এবং বিকাশে টাকা পাঠিয়ে এসব উপহার সামগ্রী কিনে তা পাঠিয়ে দিচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের বাসায়।
করোনায় সবারই মানবিক হওয়া জরুরি উল্লেখ করে এই স্বেচ্ছাসেবী তরুণী জানান, ইতোমধ্যে ২১ জন ছাত্রী এবং ১১ জন ছাত্রকে দুই হাজার টাকা করে বিকাশে পাঠিয়েছেন তিনি। সবার সাধ্যের মধ্যে এগিয়ে আসা উচিত।
সিকদার বলেন, ইফতারটা একাই পরিবেশন করছি। দুয়েকজন বন্ধু সহযোগিতা করছে। দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে গ্রামের মানুষের জন্য পুরো রমজানে ইফতারের কাজটা করতে চাই। আসলে মানবিকতা তো কোনো ধর্মের গÐিতে সীমাবদ্ধ নয়। আমি হিন্দু কিংবা অন্য ধর্মের বলে মুসলমানদের ইফতারে সহযোগিতা করতে বারণ নেই। কেননা, মানবিকতাই তো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম নিয়ামক।
তিনি বলেন, করোনায় নিজে সুরক্ষিত থেকেই ইফতার বিতরণের কাজটি করেছি। সবাইকে সরকারি নির্দেশনা মেনে সুরক্ষিত থাকার কথাও বলছি।