দুদক নাকি আওয়ামী দুর্নীতি প্রটেকশন কমিশন: নিষ্কলুষ সার্টিফিকেট পেতে যাচ্ছেন এসপি লীগের নেতা সৈয়দ নুরুল ইসলাম

আওয়ামী দুর্নীতি প্রটেকশন কমিশন খ্যাত দুদক এসপি লীগের সদ্য পদোন্নতি পাওয়া সৈয়দ নুরুল ইসলামকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিষ্কলুষ সার্টিফিকেট দিতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তাকে নিষ্কলুষ বানিয়ে গত ৩১ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে উপস্থাপন করেছেন সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন। এই তদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি এসেছে আমার দেশ-এর হাতে। ২৭ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে রয়েছে অনেক গুজামিল।

দুদক সূত্র জানায়, যে কোন সময় কমিশন থেকে নিষ্কলুষ সার্টিফিকেট ইস্যু হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন এসপি লীগের নেতা সৈয়দ নুরুল ইসলাম। আওয়ামী লীগের সদস্য হলে নিষ্কলুষ সার্টিফিকেট দেওয়াই যেন দুদক নামক আওয়ামী দুর্নীতি প্রটেকশন কমিশনের দায়িত্ব। এসপি লীগের নেতা হিসাবে পরিচিত য়ৈসদ নুরুল ইসলাম ছাত্র জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এফ রহমান হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ছিলেন।

২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর থেকে শুরু হয় তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের আনুষ্ঠানিক তদন্ত। দফায় দফায় তদন্তকারী কর্মকর্তা বদলী করা হয়েছে এসপি লীগের এই পুলিশ কর্তার দুর্নীতি তদন্তে। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়ার অভিযোগ ছিল দুর্নীতি দমন কমিশনে। এরপর প্রায় ৫ বছর হয়েছে।  সর্বমোট ৫ দফা তদন্তকারী পরিবর্তন করে এখন নিষ্কলুষ সার্টিফিকে পাচ্ছেন সৈয়দ নুরুল ইসলাম।

গত ৩১ মার্চ দুদকের উপ-পরিচালক নাছির উদ্দিনের স্বাক্ষরিত সুপারিশপত্রে দেখা যায়-সৈয়দ নুরুল ইসলাম ২০০১ সালে ২০তম বিসিএস’র ব্যাচে সহকারী পুলিশ সুপার হিসাবে চাকুরিতে যোগদান করেন। এরপরই তাঁর সম্পদ বৃদ্ধি পায় অস্বাভাবিকভাবে।

পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সুপার হিসাবে কুমিল্লা, ময়মনসিংহ এবং নারায়নগঞ্জ জেলায় দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া উপ-পুলিশ কমিশনার হিসাবে ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল জোন, যুগ্ম কমিশনার হিসাবে (ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগ) দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া সম্প্রতি ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত চলাকালীন অবস্থায় তাঁকে পদোন্নতি দিতে ১৩০জনকে ডিঙ্গানো হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের তদারকি করেন তিনি। এলাকায় তাঁর তদারকিতে রয়েছে এসপি লীগ।

সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুপারিশপত্র তৈরির আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা দুদকে প্রেরণ করা হয়। জানতে চাওয়া হয়, পদোন্নতির জন্য প্রস্তাবিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোন অভিযোগ তদন্তাধীন আছে কি না। কিন্তু ১১ মে ৩২ জন পুলিশ অফিসারকে ডিআইজি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে দুদকের ছাড়পত্র ছাড়াই। দুদক সূত্র জানায়, প্রচলিত নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সর্বশেষ ৩২ জন পুলিশ অফিসারের পদোন্নতির আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে দুদকে কোন রকমের ছাড়পত্র চাওয়া হয়নি। তাদের পদোন্নতির বিষয়ে দুদকের কোন রকমের ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। অথচ সৈয়দ নুরুল ইসলামের বিষয়ে ২০১৭ সাল থেকেই দুর্নীতির তদন্ত অব্যাহত আছে।

উপ-পরিচালক নাছির উদ্দিন স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে দেখা যায়- সৈয়দ নুরুল ইসলামের দুর্নীতির তদন্ত করতে ২০১৭ সাল থেকে দফায় দফায় তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন নিষ্কলুষ সার্টিফিকেট দিতে কমিশনে সুপারিশ করেছে।

নাছির উদ্দিনের সুপারিশকৃত ২৭ পৃষ্ঠার নথি আমার দেশ-এর কাছে এসেছে। এতে দেখা যায়, সৈয়দ নুরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি থাকার অভিযোগ ছিল। এরমধ্যে রয়েছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে ৬টি আমবাগান, ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানা মৌজায় ২টি জমি, খিলগাঁওয়ে জমি। যে গুলো তিনি ক্রয় করেছেন চাকুরিকালীন সময়ে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। নাছির উদ্দিনের অনুসন্ধানে উঠে আসে সমুদয় স্থাবর সম্পত্তির প্রাপ্ত মূল্য হচ্ছে ৭৬ লাখ ৩৪ হাজার ৮১৯ টাকা।

এরবাইরে অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে উল্লেখ রয়েছে আরো ৮১ লাখ ৫৬ হাজার ২৩৪ টাকা।

তবে এসব সম্পত্তির তালিকায় ক্রয়মূল্যের মোট ব্যায়ের ঘরটি পূরণ করা হয়নি। শুধু পৃথক মূল্যের ঘরে দেখানো হয়েছে, একটি আমবাগানের ক্রয়মূল্য ১৩লাখ টাকা। দুদকের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত মূল্য ১৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অনুরূপ প্রতিটি আমবাগানে ক্রয় মূল্যের চেয়ে দুদকের প্রাপ্ত মূল্যের সাথে গরমিল রয়েছে।

এরবাইরে আরো ১৭টি আমবাগান তার নামে লিজ নেওয়া হয়েছে। এই লিজে পরিশোধিত মূল্য সর্বনিম্ন দেড় লাখ টাকা থেকে ৯ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে এর কোন মোট মূল্য উল্লেখ করা হয়নি।
এ প্রতিবেদনে দেখা যায়, সৈয়দ নুরুল ইসলামের স্ত্রী নওরিন হক চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী। রিলায়েন্স ট্রেডিং নামে একটি কোম্পানির রয়েছে। এ কোম্পানি আমদানি-রফতানি ব্যবসার সাথে জড়িত। এছাড়া ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রিন্টার্স নামে আরেকটি কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার। তাঁর স্থাবর সম্পত্তির তালিকায় রাজশাহীতে দু’টি এবং ঢাকায় কাফরুলে একটি জমির মালিক দেখানো হলেও প্রদর্শিত মূল্য এবং অনুসন্ধানে প্রাপ্ত মূল্যের ঘরে লেখা রয়েছে প্রযোজ্য নয়। তাঁর সম্পদের মূল্য উল্লেখ করা প্রযোজ্য না হয়ে থাকলে কেন তদন্ত করা হয়েছে সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অস্থাবর সম্পদের বিবরণীতে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে একটি জমি লিজ বাবদ ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ। যেখানে ১০০টি আমগাছ রয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে বিবরণীতে। এছাড়া আমদানি-রফতানি ব্যবসার বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে ১৮লাখ ৩৩ হাজার ৩৩০ টাকা।

উল্লেখ্য, সৈয়দ নুরুল ইসলাম ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে তিনি সরাসরি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত। তিনি প্রকাশ্যেই নিজেকে দলপাগল হিসাবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। তাঁর তত্ত্বাবধানেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে পরিচালিত হয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি। এজন্য এলাকায় আওয়ামী লীগের অপর নাম হচ্ছে এসপি লীগ। তাঁর কর্মস্থলেও নিয়মিত এলাকার আওয়ামী লীগের লোকজন আসা-যাওয়া করেন। পুলিশের ইউনিফর্মধারি সরকারি অফিসকে সৈয়দ নুরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের অফিস বানিয়ে ফেলেছেন বলেও মন্তব্য করেন পুলিশের অনেক কর্মকর্তা।