এই প্রশ্নটি প্রায়ই মনে উদয় হয়, এত জায়গা থাকতে আমেরিকা তাদের ডলারের উপরেই কেন ‘আমরা স্রষ্টার উপর বিশ্বাস করি’ এই কথাটি লিখে রাখে? এমন কায়দা করে লিখেছে যে দিনে কমপক্ষে কয়েকবার দৃষ্টির মধ্যে পড়বে!
একই কিসিমের ধর্মীয় উৎপাত যদি আমাদের টাকার উপর করা হত তাহলে এদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পাহলোয়ানরা সেটা নিয়ে কেয়ামত সৃষ্টি করে বসত। প্রতিটা টাকায় এই শ্লোগান থাকা তো দূরের কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামে কুরআনের একটি আয়াতকেই এরা সহ্য করতে পারে নাই। সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার মহান উদ্দেশ্যে কুরআনের সেই আয়াতকে সরানো হলেও অন্য একটি ধর্মের ধর্মীয় প্রতীক মঙ্গল প্রদীপ বসানোতে তাদের সেই সেক্যুলারিজমের কোনো ক্ষতি করে নাই! এই সেক্যুলাররা এতটুকুই নির্বোধ- জানেও না যে কার হয়ে কাজটি করছে?
এরা এদেশে উগ্র হিন্দুত্ববাদি এবং জায়নবাদি ইহুদি গ্রুপটির ক্রীড়নক হিসাবে কাজ করে। এখানে উল্লেখ্য, জায়নবাদ এবং হিন্দুত্ববাদ মূল ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে বিচ্ছিন্ন একটা উগ্র রেসিস্ট মতবাদ।
আপনাদের হয়তোবা স্মরণে আছে যে সজীব ওয়াজেদ জয় জনৈক জায়নবাদি ইহুদি পার্টনারের সাথে মিলে একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন! সেই আর্টিকেলটিতে তিনি জানিয়েছিলেন যে দেশে বোরখার সংখ্যা ৫০০% বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশের ব্যাংক ও হাসপাতালগুলি সব মৌলবাদী হয়ে পড়েছে, দেশের সেনাবাহিনীতে সব মাদ্রাসার ছাত্র ঢুকে পড়েছে- এরকম ভয়ংকর তথ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের ইসলামোফোবিক অংশকে আরো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন! ফলে রাজাপাকসে পরিবারের চেয়েও বড় লুণ্ঠন চালিয়ে, দেশটির জনসাধারণকে টেরোরাইজ করে এবং ‘গণতন্ত্র’ শব্দটিকে স্রেফ ধর্ষণ করে নিজেদের অপশাসনটি চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
এদেশের ব্যাংক ও হাসপাতালকে মৌলবাদী ডাকলেও ‘ইন গড উই ট্রাষ্ট’ মুদ্রিত সেই ডলারকে কখনোই মৌলবাদী গণ্য করে না! সেক্যুলারদের পরম পূজনীয় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বাইবেলের উপর হাত রেখেই শপথ নেন। ক্ষমতা গ্রহণের সময় দুই তিন দিন ধরে এক নাগাড়ে আমাদের দোয়া-দুরুদ পড়ার মত অনেক কিছু পড়েন। এমন কি এক মুসলিম পিতার ছেলে নাস্তিক ওবামাকেও খাঁটি খ্রিষ্টানের মত সেই ধর্মীয় আচার পালন করতে হয়েছে। সমস্যা হলো, সেগুলোতে আরবীর গন্ধ না থাকায় আমাদের সেক্যুলারদের অনেকেই সেগুলোকে ধর্মীয় কার্যকলাপ (Ritual) বলে গণ্য করেন না! বরং আমেরিকান প্রেসিডেন্টের সে সব অনুষ্ঠানে কেউ কদাচিৎ আমন্ত্রিত হলে সে সব কথা বলে পুরো চৌদ্দ গোষ্ঠীর বুকের ছাতি ফুলে উঠে!
পশ্চিমা সভ্যতার ভিত্তি গড়ে উঠেছে তাদের ধর্মীয় বোধ থেকে। পশ্চিমা বিশ্বে পারিবারিক মূল্যবোধ বা ফ্যামিলি ভ্যালুজ বলে যে শব্দটি, তার শত ভাগ এসেছে এই ধর্মীয় বোধ থেকে! বলা হয়ে থাকে, The Christian church created the bases of the Western system of education. পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে অনেক নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরাসরি খ্রিষ্টান মিশনারি কর্তৃক পরিচালিত।
এবার প্রথম প্রশ্নে ফিরে যাই!
এক ধরণের ফ্যান্টাসি বা শখ থেকে প্রতিটা ডলারের উপরে ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’ কথাটি লেখা হয় নাই! যারা এই উদ্যোগটি নিয়েছিলেন এর পেছনে তাদের গভীর জীবন বোধ কাজ করেছে। তারা বিশ্বাস করতেন, স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস হীন নেতৃত্ব বা জনগণ এই পৃথিবীর জন্যে হুমকি স্বরূপ। পৃথিবীর সকল বিশ্বাসীগণ এই একটা পয়েন্টে সকল ধর্মহীনতা ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে এক হতে পারে। এই একটি বাক্যই বিপদসংকুল এই পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে। এই লেখাটি প্রতিমুহূর্তে স্রষ্টার অস্তিত্ব কিংবা তার কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতিটি জাগিয়ে দেয়!
মানুষ যত খারাপ কাজ বা পাপ কাজ করে তার অধিকাংশই এই টাকা বা ডলার দিয়েই সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ অন্যায় বা অনৈতিক কাজটি সম্পাদনের কোন না কোন পর্যায়ে এই ডলারটি হাতে নিতে হয়। কোনো কোনো পাপ কাজ ডলার ছাড়াই সম্পাদন করলেও দেখা যায় পরবর্তীতে তা সামলাতে বা মুখ বন্ধ করতেও এই ডলার ব্যবহার করতে হয়! স্রষ্টার উপর বিশ্বাস পাপ কাজের বিরুদ্ধে এক ধরণের লাগাম বা ব্রেক হিসাবে কাজ করে! একারণেই বোধ হয় সেক্যুলার ডলারের উপর এই ধর্মীয় বাণীটি লেখা হয়েছে।
আগের একটি লেখাতে বলেছি, আমাদের ভেতরকার পুলিশিংয়ের (Internal Policing) কাজটি করে ধর্ম। দেখলাম, কিছু গুণীজন সেখানেও আমার বক্তব্যের মূল সুরটি ধরার চেষ্টা না করে নোক্তা ধরার চেষ্টা করেছেন। সরকার ধর্মীয় শিক্ষাকে বা ধর্মকে নানা ভাবে সংকুচিত করে ফেলছে- এটি আর নতুন করে বলার কিছু নেই। সোনার ছেলেদের ভয়ে নির্মলেন্দু গুণও এখন দেশের পাবলিক ভার্সিটির হলের পাশ দিয়ে সন্ধ্যা রাতে যেতে সাহস করবেন না!
এদের বুদ্ধির ঝিলিক দেখে মিস্টার আজাজিল কিন্তু দারুণ খুশী! একবার পাঠ্যপুস্তক থেকে ইসলাম সম্পর্কিত আর্টিকেল আলগোছে সরিয়ে দেয়, অবস্থা বেগতিক দেখলে তা আবার প্রতিস্থাপন করে। আমার গত লেখার সূত্র ছিল সংসদে দেওয়া এক এমপির মন্তব্য! সেটি আগের কোন সূত্র হলেও মূল বক্তব্যটি তাতে কোনো হেরফের হয় নাই।
পারলে এরা এক ফুঁ দিয়ে ধর্মের বাতিটি নিভিয়ে দেয়। সেটি সম্ভব না হওয়াতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে আওয়ামীলীগ সিঁধেল চোরের পলিসি গ্রহণ করেছে। সিঁধ কেটে প্রথমে পা ঢুকিয়ে দেখে গৃহস্থ সজাগ আছে কি না! গৃহস্থ সজাগ আছে টের পেলেই পাটি বের করে ফেলে, লাঠির আঘাত পড়লে পায়ের উপর দিয়েই যায়। আর এক্সপেরিমেন্ট পজিটিভ হলে পুরো শরীর ঢুকিয়ে ঘর সাফ করে ফেলে!
আমাদের বোধ বিশ্বাসের ঘরটির এই সিঁধেল চোরেরা একবার পাঠ্যপুস্তক থেকে ধর্মীয় আর্টিকেল সরিয়েছে। চাপে পড়ে আবার তা অন্তর্ভুক্ত করেছে! এই সিঁধেল চোরেরা এবার একটু ভিন্ন রাস্তা ধরেছে। ধর্মশিক্ষাকে মূল সিলেবাসের বাইরে রেখেছে- গুরুত্বহীন অবস্থায়। এই বিষয়ের নম্বর যোগ হবে না, এখন একজন ছাত্রছাত্রীকে এই বইটি না পড়লেও সমস্যা হবে না। অর্থাৎ মাইর দিবে, শব্দ হবে না।
সেক্যুলারিজম নিয়ে আগে ভণ্ডামি করলেও, এই সেই বোঝালেও এখন এদের আসল পরিচয়টি বেরিয়ে আসছে। এদের খাঁটি পরিচয় এরা ধর্মহীন। কৌশলগত কারণে এরা দুয়েকটি ধর্মকে ব্যবহার করে। এদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে এরা আসলে সকল ধর্মেরই শত্রু- কারোরই বন্ধু নহে! সকল ধর্মবিশ্বাসীদের জন্যেই এরা হুমকিস্বরূপ।
এদের বিরুদ্ধে সকলেরই সজাগ হওয়া উচিত। এরা শুধু সকল ধর্মেরই না- মানবতারও চরম শত্রু।
Leave a Reply